আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
সামাজিক বিজ্ঞান

সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন উপাদান

সামাজিক পরিবর্তন : মানবসমাজ স্থিতিশীল নয়, পরিবর্তনশীল। তবে সব সমাজ একইভাবে পরিবর্তিত হয় না। এ পরিবর্তন কোথাও দ্রুত, কোথাও মন্থর। আবার অনেক সময় দেখা যায় একই সমাজের সকল অংশে সমান তালে পরিবর্তন হয় না। যেমনবাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তনের গতি খুবই মন্থর। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে পরিবর্তন হয় বেশ দ্রুত। সমাজের যে অংশে শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাব, শিক্ষার সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়ােগ ও উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা বিদ্যমান সে অঞ্চলে পরিবর্তন দ্রুত ঘটে।

সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞা

সমাজবিজ্ঞানীগণ সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কেউ কেউ সমাজব্যবস্থার আংশিক (Partial) আবার কেউ কেউ সামগ্রিক (Total) অংশে পরিবর্তনের কথা বলেন। যেমন সমাজবিজ্ঞানী রস (Ross) সমাজের আংশিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেন, “সামাজিক পরিবর্তন হল শুধুমাত্র সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের (Social institutions) এবং তাদের বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন”।

আরো পড়ুন : সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ

মরিস জিন্সবার্গ (M. Ginsberg) বলেন, “সামাজিক পরিবর্তন বলতে বুঝি সামাজিক কাঠামাের পরিবর্তন এবং সমাজত্ব লােকদের মূল্যবােধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণের পরিবর্তন”। কিংসলে ডেভিস (Kinsley Davis) বলেন, “সামাজিক পরিবর্তন হল সমাজ কাঠামাে ও কার্যাবলির পরিবর্তন।”

উপরের সংজ্ঞাগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মানবসমাজের আংশিক বা সামগ্রিক, যেকোনাে অংশের পরিবর্তনকেই সামাজিক পরিবর্তন বলা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের অর্থ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের, শ্রেণী কাঠামাের, অর্থনৈতিকব্যবস্থার, আচার ব্যবহারের, জীবনযাত্রা প্রণালির অর্থাৎ মানুষের সব রকম মৌলিক সম্পর্কের পরিবর্তন।

সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য

সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞা হতে আমরা এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। প্রথমত, সামাজিক পরিবর্তন ভৌগােলিক পরিবর্তনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দ্রুত ঘটে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমাজে বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন সত্ত্বেও সমাজের একটা মােটামুটি স্থায়িত্ব আছে, যার জন্য কোনাে একটি সমাজকে অন্য সমাজ হতে পৃথক করা যায়। তৃতীয়ত, সামাজিক পরিবর্তন কম-বেশি অনিশ্চিত বলে পরিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। চতুর্থত, বৈচিত্র্য সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সামাজিক পরিবর্তন কখনাে উন্নতির দিকে, কখনাে অবনতির দিকে, কখনাে স্থায়ী আবার কখনও অস্থায়ীভাবে হয়ে থাকে।

সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান

সামাজিক পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন উপাদান এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। সামাজিক পরিবর্তন সাধনে শিল্পায়ন, শহরায়ন, শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা, যােগাযােগ ব্যবস্থা প্রভৃতি কারণগুলাে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান বর্ণনা করা হল।

শিল্পায়ন

শিল্পায়ন বলতে মূলত কৃষি সমাজে আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের বিকাশকে বােঝায়। শিল্পায়ন অর্থনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। উৎপাদন-যন্ত্রের উন্নতির ফলে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছে। মানুষের জীবযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ যৌথ পরিবার ভেঙে শহরে একক দম্পতিকেন্দ্রিক পরিবার গঠিত হচ্ছে। সমাজে অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি ঘরের বাইরে এসে কলকারখানায় উৎপাদন-কর্মে নিয়ােজিত হচ্ছে। শিল্পায়নের আরেকটি আনুষঙ্গিক ফল হল শহর ও নগরের বৃদ্ধি। অর্থাৎ শিল্পায়ন ছাড়া কোনাে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন তথা উন্নয়ন সম্য নয়।

নগরায়ণ

নগরায়ণ বলতে বােঝায় এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনাে এলাকা নগরে বা শহরে রূপান্তরিত হয়। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে মানুষ কৃষিজ পেশা বাদ দিয়ে নানা ধরনের পেশা গ্রহণ করে বিধায় সমাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। পেশায় বৈচিত্র্য থাকায় গ্রামের মানুষ দলে দলে শহরমুখী হয়।

আরো পড়ুন : সমাজ কাঠামাে, সমাজ কাঠামাের সংজ্ঞা ও সমাজ কাঠামাের উপাদান

ফলে গ্রামীণ যৌথ পরিবার ভেঙে একক বা অণু পরিবারের সৃষ্টি হয়। শহরের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়। নারীপুরুষ পাশাপাশি শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালতে চাকরি করে জীবিকা অর্জন করে। এর ফলে মহিলাদের আগের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে বেশি স্বাবলম্বী হতে দেখা যায়। সুতরাং শিল্পায়ন ও শহরায়ন সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষা

শিক্ষা হল এমন একটি প্রকিয়া যা ব্যক্তিকে সামাজিক করে তােলে, ব্যক্তিত্বশীল করে গড়ে তােলে। শিক্ষার সম্প্রসারণের ফলে সমাজ কাঠামােতে আসে নানা ধরনের পরিবর্তন। কারণ শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এনেছে পরিবর্তন। শিক্ষার সম্প্রসারণ সমাজে জন্মহার ও মৃত্যুহার হ্রাস পেতে সাহায্য করে। দারিদ্র্য দূরীকরণে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রযুক্তিবিদ্যা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের জীবনের এমন কোনাে দিক নেই যা প্রযুক্তিবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়ােগের ফলে শিল্প-কারখানায় বৃহদায়তন উৎপাদন শুরু হয়। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। এটা মানুষের ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আগের তুলনায় মানুষ বর্তমানে অনেক বেশি বাধর্মী হয়ে পড়ছে।

যােগাযােগ ব্যবস্থা

সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম উপাদান হল যােগাযােগ ব্যবস্থা। যেমন- রাস্তাঘাট, যানবাহন, টেলিযােগাযােগ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিকস। যােগাযােগ ব্যবস্থায় যে সমাজ যত উন্নতি সাধন করেছে সে সমাজ তত আধুনিক। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়ােজন উন্নত ধরনের যােগাযােগ ব্যবস্থা ।

বাংলাদেশের সমাজে পরিবর্তন

বাংলাদেশের সমাজের পরিবর্তন বলতে আমরা বুঝি এদেশের সমাজের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান যেমন: অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রের পরিবর্তন বা এগুলাের কাঠামাে ও কার্যাবলিতে পরিবর্তন। বাংলাদেশের গ্রামের তুলনায় শহর-সমাজেই পরিবর্তনের হার দ্রুত হলেও গ্রামাঞ্চলে পরিবর্তনের ঢেউ একেবারেই লাগে নি একথা বলা যাবে না।

গ্রামাঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিক চাষাবাদের প্রচলন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি, ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে উপজেলা প্রশাসন কাঠামাে গঠন, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রচলন প্রভৃতি কারণে গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। শুধুমাত্র অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানেই নয় গ্রামীণ মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও এ পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করা যায়।

গ্রামীণ কৃষিতে যান্ত্রিক চাষাবাদ, উন্নত ধরনের বীজ, সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ভূমিতে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর সুফল ভােগ করছে মূলত গ্রামীণ ধনী কৃষক। তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে বেশি ফসল ফলিয়ে আরাে বেশি ধনী হচ্ছে। গরিব আরাে গরিব হচ্ছে। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে শশাষণের সম্পর্ক বিরাজ করায় গ্রামীণ কৃষক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে।

ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে নতুন নতুন অফিস, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ফলে ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ছােট কৃষকেরা অকৃষিজ পেশায় অংশগ্রহণ করছে। উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন অফিস-আদালতে চাকরি গ্রহণ করায় গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক পেশায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটায় গ্রামীণ ছেলেমেয়েরা বর্তমানে পূর্বের চেয়ে ব্যাপক হারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ করছে। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় গ্রামীণ মেয়েরা আগের চেয়ে লেখাপড়ার সুযােগ বেশি পাচ্ছে।

তাছাড়া খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়াতে এবং মূল্যবােধের পরিবর্তন হওয়াতে গ্রামীণ কৃষকের মেয়েরা শহরে এসে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এর ফলে পারিবারিক পরিমণ্ডলে মেয়েদের মর্যাদা, ক্ষমতা ও আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রভাবে গ্রামের যৌথ পরিবার ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে।

গ্রাম ও শহর-সমাজে স্বামী-স্ত্রীরা পরিবার ছােট রাখার মানসে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। শিক্ষার সম্প্রসারণের ফলে এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে বহু স্ত্রী-গ্রহণ প্রথা অনেক হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ের বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখছে। বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় সমাজে জীবনযাত্রা প্রণালিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ঘরবাড়ি, তৈজসপত্র ও আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশ পরিবর্তন। আগের দিনে গ্রামীণ মানুষ মাটি ও কাঁসার তৈজসপত্র ব্যবহার করত। কিন্তু এখন ঐ সবের স্থান দখল করেছে চীনামাটি, প্লাস্টিক, মেলামাইন এবং কাচের তৈজসপত্র।

শহরের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ডিজাইনের আসবাবপত্র এখন গ্রাম-সমাজে ব্যবহার হতে দেখা যায়। চিত্তবিনােদনের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরে এসেছে অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গ্রামে জারি, মুর্শিদী ও যাত্রাগানের প্রচলন বেশ কমে আসছে। এসব গুলাের স্থান দখল করেছে টিভি, ভিসিআর ইত্যাদি। ফলে চিত্তবিনােদনের প্রাচীন মাধ্যমগুলাে ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। সকল সমাজের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন স্বাভাবিক। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ও বাস্তব প্রয়ােগের মাধ্যমেই কেবলমাত্র এ পরিবর্তন সুফল বয়ে আনতে পারে।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button