আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

লিঙ্কে ক্লিক করুন
কৃষি প্রযুক্তি

ফসল উৎপাদনের জন্য জমি প্রস্তুতি | ভূমি কর্ষণ তথা জমি প্রস্তুতকরণের উদ্দেশ্য

ফসল উৎপাদনের জন্য জমি প্রস্তুতি

কৃষির যত কাজ আছে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলাে জমি প্রস্তুতি । সব ফসলের জন্য জমি প্রস্তুতি এক রকম নয়। যেমন বােরাে বা রােপা আমন ধানের ক্ষেত্রে আগে চারা উৎপাদন করতে হবে, তারপর মূল জমি প্রস্তুত করে চারা রােপণ করতে হবে। কিন্তু বােনা আউশ বা বােনা আমনের ক্ষেত্রে চারা উৎপাদন না করে সরাসরি প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। প্রায় একইরূপ গমের ক্ষেত্রেও ভালােভাবে জমি চাষ দিয়ে বীজ ছিটিয়ে বুনতে হবে। জমি প্রস্তুতির সাথে বহুমুখী কাজ জড়িত। যথা জমি চাষ, মই দেওয়া, সার প্রয়ােগ ইত্যাদি। নিচে ফসলভিত্তিক প্রত্যেকটি কাজ আলােচনা করা হলাে।

ধান চাষের জন্য জমির প্রস্তুতি

ধান বাংলাদেশে সারা বছর চাষ করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বীজতলায় চারা উৎপাদন করতে হয়। ধানের বীজতলা তৈরি ও জমি প্রস্ততি ৪র্থ অধ্যায় এর ১ম পরিচ্ছেদ থেকে আমরা জানতে পারব।

গম চাষের জন্য জমি প্রস্তুতকরণ

গম রবি শস্য। বর্ষার মৌসুম শেষ হওয়ার পর মধ্য কার্তিক-মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম চাষের উপযুক্ত সময়। মাটির ‘জো’ দেখে জমিতে লাঙল চালনা করা হয়। গমের মাটি ঝুরঝুরা করে প্রস্তুত করা প্রয়ােজন। এজন্য ৩ থেকে ৪ বার আড়াআড়ি জমি চাষ দিয়ে বার কয়েক মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করতে হয়। জমিতে যাতে কোনাে বড় ঢেলা না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। গমের জন্য দোআঁশ বা বেলে। দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। এ মাটি সহজেই ঝুরঝুরা হয়। পাওয়ার টিলারের সাথে রটোভেটর সংযােগ করে জমি চাষ দিলে মাটি ভালাে চাষ হয় এবং একই সাথে মইও দেওয়া হয়। ঝুরঝুরা মাটি গমের অঙ্কুরােদগমের জন্য খুবই উপযােগী । অষ্টম শ্রেণিতে আমরা গম চাষে সার প্রয়ােগ সম্পর্কে জেনেছি।

ডালজাতীয় শস্যের জন্য জমি প্রস্তুতি

বাংলাদেশে ডালজাতীয় শস্যের জন্য জমি চাষ করা হয় না। তবে মসুর ডালের জন্য জমিতে দুইএকটি চাষ দেওয়া হয়। বর্ষা শেষ হলে আশ্বিন-কার্তিকে যখন নদীর চর ও নিচু এলাকা হতে পানি সরে যায় তখন নরম পলি মাটিতে বিনা চাষে বীজ বপন করা হয়। চাষ দেওয়া সম্ভব হলে দুইএকটি চাষও দেওয়া হয়। চাষের পর পতিত জমিতে আবার অনেক সময় রােপা ও বােনা আমনের জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় ডালের বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি

নিচু এলাকায় বর্ষার পানি নেমে গেলে বা উঁচু এলাকায় আশ্বিন মাস হতে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির কাজ শুরু করা হয়। সাধারণত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে আলুর চাষ করা হয়। এই মাটি চাষ করা মােটামুটি সহজ। আলুর জমি ৫-৬ বার চাষ ও বার কয়েক মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে জমি প্রস্তুত করা হয় । আজকাল পাওয়ার টিলার দ্বারা চাষ করা হয় বলে ৩-৪ বার আড়াআড়ি চাষ দিলেই ঝুরঝুরা হয় এবং সমান করা হয়।

নালা তৈরি ও সার প্রয়ােগ পদ্ধতি

জমি ভালােভাবে চাষ ও মই দেওয়ার পর জমি সমান করে বীজ বপনের জন্য জমির এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত নালা করতে হবে। প্রত্যেকটি নালা প্রায় ১০-১২ সেমি গভীর করতে হবে। একটি নালা থেকে আর একটি নালার দূরত্ব হবে ৬০ সেমি । অতঃপর নালার মধ্যে ১৫ সেমি দূরে দূরে বীজ বুনে দিতে হয়। আলুচাষে সার প্রয়ােগ পদ্ধতি পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে।

জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব

ভূমি কর্ষণ জমি প্রস্তুতির প্রথম ধাপ । ভূমি কর্ষণের সংকীর্ণ অর্থ হলাে ফসল ফলানাের উদ্দেশ্যে জমির মাটি যন্ত্রের সাহায্যে খুঁড়ে আলগা করা। কিন্তু ভূমি কর্ষণের সাথে নানা প্রযুক্তি জড়িত। যেমন, বীজকে অঙ্কুরােদগমের জন্য উপযুক্ত স্থানে ও সঠিক গভীরতায় স্থাপন করা, মাটিতে বায়ু চলাচলের সুবিধা সৃষ্টি করা, উপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি উপরে নিয়ে আসা, মাটিতে অণুজীবের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। এসব দিক বিবেচনা করে জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আর এই গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য ভূমি কর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে “শস্যের বীজ মাটিতে সুষ্ঠুভাবে বপন ও পরবর্তী পর্যায়ে চারাগাছ বৃদ্ধির জন্য মাটিকে যে প্রক্রিয়ায় খুঁড়ে বা আঁচড়ে আগাছামুক্ত, নরম, আলগা ও ঝুরঝুরা করা হয় তাকে ভূমি কর্ষণ বলে”। ভূমি কর্ষণ জমি প্রস্তুতির প্রাথমিক ধাপ।

আদিকাল থেকেই মানুষ ভূমি কর্ষণ তথা জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই তারা কাঠের বা পাথরের তৈরি সুচালাে যন্ত্রের সাহায্যে মাটি আলগা ও নরম করে ফসলের বীজ বুনতে বা চারা রােপণ করতেন। ফসলভেদে ভূমি কর্ষণের তারতম্য হতে পারে কিন্তু এর গুরুত্ব কখনাে খাটো করে দেখার বিষয় নয়। জমি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে খনার বচনে উল্লেখ আছে যে,

যােল চাষে মুলা
তার অর্ধেকে তুলা
তার অর্ধেকে ধান
বিনা চাষে পান

অর্থাৎ মুলা চাষের জন্য ষােলটি চাষ দিতে হবে যতক্ষণ না মাটি ঝুরঝুরা বা আলগা হয়। তুলা চাষের জন্য আট চাষ দিতে হবে আর ধানের জন্য চারটি চাষই যথেষ্ট। মজার ব্যাপার হলাে পান উৎপাদনে কোনাে চাষই লাগেনা। আর এই ধারণা থেকেই আজকাল বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বিনা চাষ’ প্রথা প্রচলন করা হয়েছে । এখন অনেক কৃষকই বিনা চাষে ভুট্টা, ডাল ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করেন ।

ভূমি কর্ষণ তথা জমি প্রস্তুতকরণের উদ্দেশ্য

ভূমি কর্ষণের উদ্দেশ্য থেকেই জমি প্রস্তুতকরণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করা যায় । নিচে ভূমি কর্ষণের উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলাে:

১। মাটি বীজের অঙ্কুরােদগম অবস্থায় আনয়ন : যে প্রক্রিয়ায় মাটিকে ঝুরঝুরা করে বীজের অঙ্কুরােদগমের
অবস্থায় আনা ও ফসল জন্মানাের উপযােগী করা হয় তাকে কর্ষণ বলে। জমিতে বারবার চাষ দেওয়ার ফলে মাটি নরম হয়, দানাগুলাে মিহি হয় আর তাতে বীজ গজাননা ও ফসল জন্মানাের এক ভৌত অবস্থা সৃষ্টি হয়। জমি কীভাবে কতটুকু প্রস্তুত করা হবে তা নির্ভর করে মাটির প্রকারভেদ, মাটির জৈব পদার্থ ও রস এবং ফসলের প্রকারের উপর। দোআঁশ, বেলে বা বেলে দোআঁশ মাটির মতাে হালকা মাটিতে ৩/৪ বার চাষ ও মই দিলে ভূমি কর্ষণ ফসল উৎপাদন উপযােগী হয়। কিন্তু কাদামাটির মতাে ভারী মাটিতে ৫/৬ বার চাষের প্রয়ােজন পড়ে। মাটিতে রস থাকলে চাষের সময় মাটি সহজেই ঝুরঝুরা হয় আর রস না থাকলে বড় বড় ঢেলা হয়। মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকলে মাটির কণা দানাদার হয় ও সংযুক্ত থাকে। আর তাতে বীজের অবস্থান ভালাে থাকে এবং সহজেই অঙ্কুরােদগম হয়।

২। মাটি সার ও জৈব পদার্থের মিশ্রকরণ : জমিতে সার এবং জৈব পদার্থ প্রয়ােগ করতে হয় । ভূমি কর্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলাে মাটির সাথে সার ও জৈব পদার্থের মিশ্রণ ঘটানাে। এ জন্যে জমি দুই একবার চাষ দেওয়া হলে গােবর বা কমপােস্ট জমিতে ছিটাতে হয়। পরবর্তী চাষের সময় এগুলাে মাটিতে মিশে যায়। অনেক সময় ধৈঞ্চার চাষ করেও সবুজ সার হিসাবে ফুল আসার আগে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মেশানাে হয়। তাতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।

৩। ভূ-অভ্যন্তরস্থ কীট-পতঙ্গ দমন : মাটির অভ্যন্তরে অনেক পােকা আছে যেগুলাে ফসলের অনেক ক্ষতি করে। ভূমি কর্ষণের সময় এসব পােকা, পুত্তলি ও ডিম উন্মুক্ত হয় এবং পাখিরা এগুলাে খেয়ে নিধন করে। আর সূর্যালােকও সেগুলাে ধ্বংস করে। মাটির নিচের পােকাগুলাের মধ্যে উই, উরচুঙ্গা ও পিপীলিকা প্রধান।

৪। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ : ভূমি কর্ষণ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। অকর্ষিত ভূমি থেকে পানি তাড়াতাড়ি বাষ্প হয়ে যায় অথবা পানি গড়িয়ে অন্যত্র চলে যায় । কিন্তু কর্ষিত জমিতে সার বা সেচের পানি আটকা পড়ে যা পরে মাটি শুষে নেয়। অর্থাৎ কর্ষিত জমির মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। এরূপ মাটিতে বীজ বুনলে ভালাে অঙ্কুরােদগম হয় এবং ফসলের বৃদ্ধি ঘটে।

৫। মাটিস্থ জীবাণুসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি : মাটিতে অনেক জীবাণু আছে যা মাটিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে তন্মধ্যে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া প্রধান। এসব জীবাণু মাটিতে থেকে মাটির জৈব পদার্থ পচনে সাহায্য করে। ভালােভাবে ভূমি কর্ষণ করলে মাটিস্থ এই জীবাণুগুলাের কার্যকারীতা বৃদ্ধি পায়। গাছ সহজে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে এবং ফলন অনেক ভালাে হয় ।

৬। মাটির ক্ষয়রােধ : ভূমি কর্ষণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলাে উঁচু-নিচু জমিকে সমতল করা এবং আঁটসাঁট করা । তাতে বৃষ্টির বা সেচের পানি গড়িয়ে অন্যত্র যেতে পারে না। আর এতে একদিকে ভূমিক্ষয় নিরােধ হয় আর অন্যদিকে পানির সুব্যবহার হয়।

জমি চাষের বিবেচ্য বিষয়

জমি কীভাবে চাষ করতে হবে তা নির্ভর করে কতকগুলাে বিষয়ের উপর। বিষয়গুলাে হচ্ছে :
১। ফসলের প্রকার
২। মাটির প্রকার
৩। আবহাওয়া ও
৪। খামারের প্রকার ইত্যাদি।

১। ফসলের প্রকার : জমি চাষ কেমন হবে তা নির্ভর করে কৃষক কী কী ফসল ফলাবেন। যেমন ধান চাষের জন্য কয়েকবার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি কর্দমাক্ত করতে হয়। কিন্তু মুলা, মরিচ, ইত্যাদির জন্য মাটি মিহি ঝুরঝুরা করে চাষ করতে হয় । আখ ও আলু চাষের জন্য গভীরভাবে জমি চাষ করতে হয়।

২। মাটির প্রকার : জমি চাষ মাটির প্রকারের উপর নির্ভর করে। কাদা মাটিতে বেশি আর্দ্রতা বা ভেজা থাকলে চাষ করা যায় না । মাটির “জো” আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আবার হালকা মাটি যেমন দোআঁশ, পলি দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে আর্দ্রতা একটু বেশি থাকলেও চাষ করা যায়। এই মাটিগুলাে চাষের জন্য খুব ভালাে।

৩। আবহাওয়া : আবহাওয়ার প্রভাবে মাটিতে আর্দ্রতার তারতম্য ঘটে। বৃষ্টি-বাদল কম হলে মাটিতে আর্দ্রতার অভাব ঘটে। এই অবস্থায় জমিতে গভীর চাষ দেওয়া অনুচিত। মাটিতে গভীর চাষ দিলে আদ্রর্তার অভাব দেখা দিবে। আবার বর্ষাকালে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তখন মাটিতে প্রচুর আর্দ্রতা থাকে এবং রােপা আমন চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা সহজ হয়।

৪। খামারের প্রকার : বাড়ির আশে পাশের জমিতে নিবিড় শস্য চাষ করা হয়। নিবিড় শস্য চাষে একটা
ফসল তুলেই আর একটা ফসল লাগানাে হয়। তখন জমিতে গভীর চাষের দরকার পড়ে না। জমির মাটি এমনিতেই আলগা থাকে। তবে অনিবিড় শস্য চাষে জমিতে গভীর চাষের দরকার পড়ে।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button