আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা

প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস

প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই তার স্বভাব। এভাবে বাস করতে হলে চাই একে অন্যের সাথে সহযােগিতা। এ কারণেই মানুষের প্রয়ােজন পড়ে বিভিন্ন সামাজিক অর্থনেতিক ও রাজনৈতিকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা। জীবন বাঁচাতে প্রধান তিনটি জিনিসের প্রথম প্রয়ােজন- খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। এর পরই মানুষ জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনােযােগ দেয় শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, আইন প্রভৃতির উন্নয়নে। সমাজ জীবন বিকাশে মানুষের এ সমস্ত কাজকর্মের একত্রিত রূপই হচ্ছে তার সংস্কৃতি। আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলার প্রাচীন মানুষ একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলেছিল। বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির এটাই সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। পণ্ডিতদের মতে, এদের ভাষার নাম ছিল ‘অস্ট্রিক। জাতি হিসেবে এদের বলা হতাে নিষাদ। এরপর বাংলার ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর সাথে মিশে যায় ‘আলপাইন’ নামে এক জাতি। আর্যরা এদেশে আসার পূর্বে এরা মিলেমিশে বাংলার সংস্কৃতি গড়ে তােলে। বাঙালির জনপ্রকৃতিতে বিভিন্ন মানবগােষ্ঠীর ধারা এসে মিলিত হয়েছে। এটি তাদেরকে ‘সংকর-জন’ হিসেবে পরিচিত করেছে। বহু বছর বিচিত্র আদান-প্রদান ও মিশ্রণের ফলে বাঙালির একটি নিজস্ব দৈহিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে।

এই অধ্যায় শেষে আমরা —

  • প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার বর্ণনা করতে পারব।
  • প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার বর্ণনা করতে পারব।
  • প্রাচীন বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • প্রাচীন বাংলার ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতিতে জনগণের প্রদর্শিত মূল্যবােধ ও বিশ্বাস ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশসমূহের অবদান সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পােষণ করতে সক্ষম হব;
  • ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হব ।

প্রাচীন বাংলার সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি

প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন

মৌর্য শাসনের পূর্বে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে তেমন কোনাে রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠেনি। এ সময়ে সমাজ বিভিন্ন গােত্রে বিভক্ত ছিল। একে বলা হতাে কৌম সমাজ। আর্যপূর্ব কিছু কিছু ধর্মচিন্তা বা দর্শন পরবর্তী সময়ে এদেশের হিন্দু ধর্মে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে- কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, যােগ সাধনা ইত্যাদি। এ যুগের অনেক সামাজিক প্রথা ও আচার-আচরণের প্রভাব পরবর্তী সময়ে হিন্দু সমাজে লক্ষ করা যায়। যেমন— অতিথিদের পান-সুপারি খেতে দেওয়া, শিবের গীত গাওয়া, বিয়েতে গায়ে হলুদ দেয়া, ধুতি-শাড়ি পরা এবং মেয়েদের কপালে সিঁদুর দেয়া ইত্যাদি।

আর্য সমাজে জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। তারা দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করার ফলে বাংলায়ও এ ব্যবস্থা চালু হয়। তখন হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি বর্ণের বিভাজন ছিল। পরবর্তী সময়ে আরও নানা প্রকার সংকর অর্থাৎ মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। সমাজে প্রত্যেক জাতিরই নির্দিষ্ট পেশা ছিল । অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও পূজা-পার্বণ করা- এগুলাে ছিল ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট কর্ম । তারা সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করতাে। ক্ষত্রিয়দের পেশা ছিল যুদ্ধ করা। ব্যবসা-বাণিজ্য করা ছিল বৈশ্যদের কাজ। সবচেয়ে নীচু শ্রেণির শূদ্ররা সাধারণত কৃষিকাজ, মাছ শিকার ও অন্যান্য ছােটখাটো কাজ করত। ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকি সব বর্ণের মানুষ একে অন্যের সাথে মেলামেশা করতাে।

সাধারণত এক জাতির মধ্যেই বিবাহ হতাে, তবে উচ্চ শ্রেণির বর ও নিম শ্রেণির কনের মধ্যে বিবাহও চালু ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসব ব্যাপারে কঠোর নিয়ম চালু হয়। বাঙালি মেয়েদের গুণাবলির সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখত । সে যুগে অবরােধ বা পর্দাপ্রথা ছিল। একটি বিবাহ ছিল সমাজের নিয়ম। তবে পুরুষেরা বহু স্ত্রী রাখতে পারত। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করতে হতাে। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও মৃত স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হতাে। এ প্রথাকে বলা হয় সতীদাহ প্রথা। ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনাে আইনগত অধিকার ছিল না। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাঙালির উন্নত চরিত্রের কথা জানা যায়। কিন্তু তাই বলে বাঙালির সামাজিক জীবনে কোনােরূপ দুর্নীতি ও অশ্লীলতা ছিল না, এমন কথা বলা যায় না। বাঙালির প্রধান খাদ্য বর্তমান সময়ের মতাে তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি। চাল থেকে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও জনপ্রিয় মুখরােচক খাবার ছিল। বাঙালি ব্রাহ্মণেরা আমিষ খেত। তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত।

পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল। তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, কাঁকরােল, কচু উৎপন্ন হতাে। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। তবে ডালের কথা কোথাও বলা নেই। দুধ, নারকেলের পানি, ইক্ষুরস, তালরসসহ নানা প্রকার পানীয় খাবার প্রচলিত ছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষে মসলাযুক্ত পান খাওয়ার রীতি ছিল । পপাশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে রাজা-মহারাজা ও ধনীদের কথা বাদ দিলে বিশেষ কোনাে আড়ম্বর তখন ছিল। বাংলার নর-নারীরা যথাক্রমে ধুতি ও শাড়ি পরিধান করত । মাঝে মাঝে পুরুষেরা গায়ে চাদর আর মেয়েরা পরতাে ওড়না। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ পােশাকের ব্যবস্থা ছিল।

পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই অলঙ্কার ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। তারা কানে কুণ্ডল, গলায় হার, আঙ্গুলে আংটি, হাতে বালা ও পায়ে মল পরিধান করত। মেয়েরাই কেবল হাতে শঙ্খের বালা পরত এবং অনেক চুড়ি পরতে ভালােবাসত । মণি-মুক্তা ও দামি সােনা-রুপার অলঙ্কার ধনীরা ব্যবহার করত। মেয়েরা নানাপ্রকার খোপা বাধত। পুরুষদের বাবরি চুল কাঁধের ওপর ঝুলে থাকত। কপূর, চন্দন প্রভৃতি প্রসাধনসামগ্রীর সঙ্গে বিভিন্ন সুগন্ধির ব্যবহারের প্রচলন ছিল। মেয়েদের সাজসজ্জায় আলতা, সিঁদুর ও কুমকুমের ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল। পুরুষেরা মাঝে মধ্যে কাঠের খড়ম বা চামড়ার চটিজুতা ব্যবহার করত । তখন ছাতারও প্রচলন ছিল।

তখনকার দিনে নানা রকম খেলাধুলা ও আমােদ-প্রমােদের ব্যবস্থা ছিল। পাশা ও দাবা খেলার প্রচলন ছিল। তবে নাচ-গান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল খুব বেশি। বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢাক, ঢােল, খােল, করতাল ইত্যাদি তাে ছিলই, এমনকি মাটির পাত্রকেও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহার করা হতাে। কুস্তি, শিকার, ব্যায়াম, নৌকাবাইচ ও বাজিকরের খেলা পুরুষদের খুব পছন্দ ছিল। নারীদের মধ্যে উদ্যান রচনা, জলক্রীড়া ইত্যাদি আমােদ-প্রমােদের প্রচলন ছিল।

অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক আচার-আচরণ অনুষ্ঠান সে যুগেও প্রচলিত ছিল। বারাে মাসে তেরাে পার্বণ অনুষ্ঠিত হতাে। এ উপলক্ষে নানা প্রকার আমােদ-উৎসবের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীনকালে বাংলায় বর্তমানকালের ন্যায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, রথযাত্রা, অষ্টমী স্নান, হােলি, জন্মাষ্টমী, দশহরা, অক্ষয় তৃতীয়া, গঙ্গাস্নান প্রভৃতি সুপরিচিত অনুষ্ঠান সেকালেও প্রচলিত ছিল। এসব আমােদ-উৎসব ছাড়াও তখন হিন্দুধর্মে অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও দেখা যায়। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, সীমন্তোন্নয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতাে । জন্মের পর নামকরণ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি উপচার পালন করা হতাে। প্রাচীনকালে বাংলার জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন তিথিতে কী খাদ্য নিষিদ্ধ, কোন তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, শিশু বয়সে পড়াশুনা শুরু করা, বিদেশ যাত্রা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির জন্য কোন কোন সময় শুভ বা অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ম কঠোরভাবে পালিত হতাে।

প্রাচীন বাংলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি ও নৌকা। খাল-বিলে চলাচলের জন্য ভেলা ও ডােঙ্গা ব্যবহার করা হতাে। মানুষ ছােট ছােট খাল পার হতাে সাঁকো দিয়ে। ধনী লােকেরা হাতি, ঘােড়া, ঘােড়ার গাড়ি প্রভৃতি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতাে। তাদের স্ত্রী-পরিজনেরা নৌকা ও পালকিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা-যাওয়া করতাে। বিয়ের পর নববধূকে গরুর গাড়ি বা পালকিতে করে শ্বশুরবাড়ি আনা হতাে। সর্বোপরি মনে হয় যে, আধুনিক কালের গ্রামীণ জীবনযাত্রা এবং সেকালের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না।

কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। মানুষের জীবন মােটামুটি সুখের ছিল। তবে প্রাচীন বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের কথাও জানা যায় । সমাজের উঁচু শ্রেণি অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের হাতে ছিল মূল ক্ষমতা। এ সময় শুধু ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা করতে পারতাে। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এ উৎপাত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অধিক হতাে। শেষ দিকে সেন রাজাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। সেন বংশের শাসনামলে বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিতে নেমে আসে দুর্দশা। ব্রাহ্মণদের প্রভাবে সেনদের সময়ে সাধারণ হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রাচীন বাংলার শেষ পর্যায়ে এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলমান সমাজের ভিত গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলায় মধ্যযুগের সূচনা হয়। আর এ যুগে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির রূপও পাল্টে যায়।

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

বাংলা চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। প্রাচীনকালে অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বাস করতাে আর গ্রামের আশপাশের ভূমি চাষ করে সংসার চালাতাে। তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির ওপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এ ছাড়া, পাট, ইক্ষু, তুলা, নীল, সরিষা ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি। এলাচি, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলাও বঙ্গে উৎপন্ন হতাে। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, হাঁস-মুরগি, কুকুর ইত্যাদি ছিল প্রধান। লবণ ও শুটকি দেশের কোনাে কোনাে অংশে উৎপন্ন হতাে।

কুটির শিল্পে প্রাচীন বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। গ্রামের লোেকদের দরকারি সব কিছু গ্রামেই তৈরি হত। মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল কলস, ঘটি-বাটি, হাঁড়ি-পাতিল, বাসনপত্র ইত্যাদি। লােহার তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল দা, কুড়াল, কোদাল, খন্তা, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি। এছাড়া জলের পাত্র, তীর, বর্শা, তলােয়ার প্রভৃতি যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতাে। বিলাসিতার নানা রকম জিনিসের জন্য স্বর্ণ-শিল্প ও মণি-মাণিক্য শিল্প অনেক উন্নতি লাভ করেছিল। কাঠের শিল্পও সে সময়ে অত্যন্ত উন্নত ছিল। সংসারের আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ি, মন্দির, পাল্কি, গরুর গাড়ি, ঘােড়ার গাড়ি, রথ প্রভৃতি কাঠের দ্বারাই তৈরি হতাে। এছাড়া নদীপথে চলাচলের জন্য নানা প্রকার নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য কাঠের বড় বড় নৌকা বা জাহাজ তৈরি হতাে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হলেও অতি প্রাচীনকাল থেকে এখানে নানা প্রকার শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতাে ।

বস্ত্র শিল্পের জন্য বাংলা প্রাচীনকালেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় তৈরি হতাে। এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যির কৌটায় ভরা যেত। কার্পাস তুলা ও রেশমের তৈরি উন্নতমানের সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যও বঙ্গ প্রসিদ্ধ ছিল। শণের তৈরি মােটা কাপড়ও তখন প্রস্তুত হতাে। জানা যায় যে,বঙ্গদেশে সে সময় টিন পাওয়া যেত। বঙ্গে কৃষি ও শিল্পদ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল। আবার এগুলাের খুব চাহিদাও ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাই বঙ্গের সঙ্গে প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বঙ্গের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল সুতি ও রেশমি কাপড়, চিনি, গুড়, লবণ, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা, চাল, নারকেল, সুপারি, ঔষধ তৈরির গাছপালা, নানা প্রকার হীরা, মুক্তা, পান্না ইত্যাদি। শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল।

স্থল ও জল উভয় পথেই বাণিজ্যের আদান-প্রদান চলত । দেশের ভেতরে বাণিজ্য ছাড়াও সে সময়ে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত ছিল । স্থল ও জলপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলতাে। এ কারণে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল। এগুলাে হলাে-নব্যাবশিকা, কোটীবর্ষ, পুণ্ড্রবর্ধন, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি। অবশ্য শহর ছাড়া গ্রামের হাটবাজারেও কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য চলতাে। এসব গ্রামের হাটে গ্রামে উৎপন্ন ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র বেচাকেনা হতাে। সমুদ্রপথে সিংহল, ব্ৰহ্মদেশ, চম্পা, কম্বােজ, যবদ্বীপ, মালয়, শ্যাম, সুমাত্রা, চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলতাে। স্থলপথে চীন, নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল।

শিল্পের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাংলার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল । প্রাচীনকালে হয়ত ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পূর্বে বাংলায় মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশে বিভিন্ন প্রকার মুদ্রা চালু থাকলেও এখানে কড়ি সবচেয়ে কম মান হিসেবে ব্যবহৃত হতাে।

শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য

বাংলাদেশের নানাস্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নানা কারণে এসব শিল্পকলা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত ছিল।

স্থাপত্য : প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন অতি সামান্যই আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন দেশের ভ্রমণকারী ফা-হিয়েন ও হিউয়েন-সাংয়ের বিবরণী এবং শিলালিপি থেকে প্রাচীন যুগে বাংলার কারুকার্যময় বহু হ্য, (চূড়া, শিখা) মন্দির, স্থূপ ও বিহারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের স্থাপত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে বৌদ্ধ স্তুপ। গৌতম বুদ্ধের দেহের হাড় বা তার ব্যবহার করা জিনিসপত্রের ওপর স্থূপ নির্মাণ করা হতাে। পরে জৈন ধর্মাবলম্বীরাও স্থূপ নির্মাণ করত। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস ও বিদ্যাচর্চা। করার জন্য বিহার নির্মাণ করতাে। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সােমপুর মহাবিহার পাল যুগে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া, কয়েক বছর পূর্বে কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে কয়েকটি বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি শালবন বিহার নামে পরিচিত।

ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার মন্দির এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রাচীনকালে অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এ সকল মন্দির পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত দেব-দেবীর মূর্তি এ যুগের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। মূর্তি নির্মাণে সাধারণত অষ্টধাতু ও কষ্টিপাথর ব্যবহার করা হতাে। এছাড়া, সােনা ও রুপার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। অতি সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলার ৫০টি স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর ও প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম-কাঠের হাতিয়ার, তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির প্রত্নবস্তু। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরী। এখান থেকে। ই আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পাকা রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তাসহ ইটনির্মিত স্থাপত্য কীর্তি। পুরাতন ব্ৰহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি নদীবন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র।

এখানে বিকশিত হয়েছিল স্বল্পমূল্যবান পাথরের নয়নাভিরাম পুঁতি তৈরির কারখানা। এখানে আবিষ্কৃত উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও মুদ্রাভাণ্ডার, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি, হরেক রকমের পুতি,সুদর্শন লকেট ও মন্ত্রপূত কবচ, বাটখারা, পােড়ামাটির ও ধাতব শিল্পবস্তু, মৃৎপাত্র, চিত্রশিল্প ইত্যাদি শিল্পীর দক্ষতা, উন্নত শিল্পবােধ ও দর্শনের পরিচয় বহন করে। বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধধর্ম প্রচারক ও পণ্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের প্রাচীন বজ্রযােগিনী গ্রামে সম্প্রতি একটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করছেন এটি অষ্টম বা নবম শতকে নির্মিত বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহার। বিক্রমপুর থেকে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন, দারু (কাঠ) ও পখির নির্মিত ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতি প্রত্নবস্তু প্ৰাক-মধ্যযুগের সমৃদ্ধ সভ্যতার পরিচয় বহন করে।

ভাস্কর্য : প্রাচীন বাংলায় স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি ভাস্কর্য শিল্পের চর্চাও হতাে। প্রাচীন বাংলায় বহু মন্দির ছিল। তাই ভাস্কর্য শিল্পকলাও যে উন্নত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। অনেক স্থানে মন্দির ধ্বংস হলেও তার মধ্যের দেব-দেবীর মূর্তি রক্ষিত হয়েছে। পাহাড়পুরের মন্দির গাত্রে খােদিত পাথর ও পােড়ামাটির ফলক থেকে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। খােদিত ভাস্কর্য ছাড়াও প্রাচীন বাংলায় পােড়ামাটির শিল্প খুবই উন্নত ছিল। কুমিল্লার ময়নামতি ও লালমাই পাহাড়ে বেশ কিছু পােড়ামাটির ফলক ও মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

চিত্রশিল্প : পাল যুগের পূর্বেকার কোনাে চিত্র আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রাচীনকালেই যে বাংলায় চিত্র অঙ্কনের চর্চা ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। সাধারণত বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের দেয়াল সৌন্দর্যময় করার জন্য চিত্রাঙ্কন করার রীতি প্রচলিত ছিল। তখনকার দিনে বৌদ্ধ লেখকা তালপাতা অথবা কাগজে তাদের পুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন। এ সকল পুঁথি চিত্রায়িত করার জন্য লেখক ও শিল্পীরা ছােট ঘােট ছবি আঁকতেন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনেও প্রাচীন বাংলার শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। রাজা রামপালের রাজত্বকালে রচিত ‘অষ্টসাহস্ত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ পুঁথি বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনের আর একটি দৃষ্টান্ত হলাে সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডােম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পিঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র।

বাংলা ভাষাসাহিত্য : উদ্ভব ও বিকাশ

অস্ট্রিক ছিল বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা। এ ভাষা আর্যদের আগমনের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। ৯ আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার হয়। পুরনাে ভাষাকে সংস্কার ও করা হয়েছে বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। অনেকে বলেন, সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতগণ তা মেনে নেননি। প্রাচীন যুগে আর্যদের যে ভাষায় বৈদিক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল স্থানভেদে এবং সময়ের বিবর্তনে তার অনেক পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি হয়। অপভ্রংশ ভাষা থেকে অষ্টম বা নবম শতকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। যেমন : কৃষ্ণ> কানু > কানাই। বাংলা ভাষার এরূপ প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল থেকে সংগৃহীত চর্যাপদে। এ চর্যাপদগুলাের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদগুলাের মূল্য অপরিসীম।

প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন, মূল্যবােধ ও বিশ্বাস

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় অবস্থা

প্রাচীন বাংলায় বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার পূর্বে অন্য কোনাে ধর্মমত প্রচলিত ছিল কি-না, সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে সে সময় ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর লােকেরা পূজা-অর্চনা, ভয়-ভক্তি ও সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। তখন দেশব্যাপী ধর্মের প্রকৃতি একই রকম ছিল না। বরং বর্ণ, শ্রেণি, কৌম, জনপদ ইত্যাদির বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-কর্মেও বিভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। তদুপরি, তাদের প্রাচীন ধর্মমত, সংস্কার, পূজা-পদ্ধতি প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়ে বৈদিক ধর্মের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নারী জাতির মধ্যে প্রচলিত বৃক্ষপূজা, পূজা-পার্বণে আম্রপল্লব, ধানছড়া, দূর্বা, কলা, পান-সুপারি, নারকেল, ঘট, সিঁদুর প্রভৃতির ব্যবহার ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠীর লােকদের দান।

একইভাবে মনসা পূজা, শ্মশান কালীর পূজা, বনদুর্গাপূজা, ষষ্ঠীপূজা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠীর লােকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরই পরিচয় বহন করে। খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনাে, শবর প্রভৃতি কৌমের লােকেরা তাদের আদিম পুরুষদের মতাে আজও দেবতার আসনে বসিয়ে গাছ, পাথর, পাহাড়, পশু-পাখি ও ফল-মূলের পূজা করে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব চার শতক থেকেই উপমহাদেশের তিনটি বৃহৎ ধর্ম-বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত এখানে আর্য-বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রসার লাভ করেনি।

মধ্যদেশ থেকে এসে ব্রাহ্মণেরা বঙ্গদেশের নানা জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল। এভাবে ষষ্ঠ শতকে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার সীমানা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। পাল শাসনামলেও বৈদিক ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তি অটুট ছিল। বর্ম ও সেন রাজাদের প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। এই দুই বংশের রাজত্বকালে বৈদিক ধর্ম আরও প্রসার লাভ করে। তখন বৌদ্ধধর্ম অনেকখানি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক যাগ-যজ্ঞে পৌরাণিক দেব-দেবী ও বিশেষ বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে স্নান-দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্মের প্রচলন শুরু হয়। নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি সংস্কার ও বাঙালি ব্রাহ্মণ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।

বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বাংলার বুকে দ্রুত প্রসার লাভ করলেও কালক্রমে এর মধ্যে বিবর্তন দেখা দেয়। এ যুগে পূর্বের দেব-দেবীর পরিবর্তে নতুন নতুন দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। এ নতুন দেব-দেবীরা ছিলেন মূলত পুরাণ ও মহাকাব্যে বর্ণিত দেব-দেবী। তাই এ ধর্মকে ‘পৌরাণিক ধর্ম বলা হয়। পুরােহিতরা ধর্ম-কর্ম পরিচালনা করার সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডে জটিলতা বেড়ে যায়। দেবতার বেদিতে দুধ ও ঘৃত উৎসর্গের পরিবর্তে পশুবলি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়।

পৌরাণিক পূজা-পার্বণের রীতি-নীতি ও ক্রিয়াকলাপ থেকে যে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়, সেগুলাের মধ্যে বৈষ্ণবধর্ম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। গুপ্তযুগে শিবধর্মও প্রচলিত ছিল। এ সকল দেব-দেবীর পূজা ব্যতীত শক্তি ও সূর্যপূজা ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। উত্তরবঙ্গে জৈন সম্প্রদায়ও বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধধর্ম একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পাল রাজাদের সুদীর্ঘ চারশ’ বছরের রাজত্বকালে তাঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলা-বিহার ছাড়িয়ে এ ধর্ম আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সেন যুগে বিষ্ণু, শিব, পার্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং বহু মন্দির নির্মিত হয়। ফলে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটে।

সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দাপটে বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটে। তারপর শেষ আঘাত আসে তুর্কি মুসলমানদের নিকট থেকে। প্রাচীন বাংলায় বহু ধর্ম-সম্প্রদায়ের সহ-অবস্থান থাকলেও এদের মধ্যে কলহ ও হিংসা-দ্বেষ ছিল না। তারা পরস্পর মিলেমিশে পাশাপাশি বাস করতাে। বিশেষ করে পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষক হয়েও অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এ যুগে বাংলার ধর্মীয় জীবন খুব উন্নত ছিল এবং পরধর্মসহিষ্ণুতা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

প্রাচীন বাংলার আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতি

প্রাচীন বাংলায় পূজা-পার্বণ ও আমােদ-প্রমােদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা অর্থাৎ দুর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতাে । বিজয়া দশমীর দিন শাবােরৎসব’ নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতাে। হােলাকা বা বর্তমানকালের ‘হােলি’ ছিল তখন অন্যতম প্রধান উৎসব। স্ত্রী-পুরুষ সকলে এতে যােগদান করতাে। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আকাশপ্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, গঙ্গাস্নান, মহাঅষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান ইত্যাদি বর্তমানের সুপরিচিত অনুষ্ঠান সেকালেও প্রচলিত ছিল।

এসব পূজা-পার্বণ আমােদ-উৎসব ব্যতীত হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও শােষ্যন্তীহােম অনুষ্ঠিত হতাে। জন্মের পর জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রাশনসহ অনেক উপাচার পালন করা হতাে। বাংলার হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল। কোন তিথিতে কী কী খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধ, কোন তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, অধ্যয়ন, বিদেশ যাত্রা, তীর্থ গমন প্রভৃতির জন্য কোন কোন কাল শুভ বা অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন কঠোরভাবে পালিত হতাে।

তখনকার দিনে বাঙালি পুরুষদের কোনাে সুনাম ছিল না, বরং তারা বিবাদপ্রিয় ও উদ্ধত বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখতাে। শিক্ষিত সমাজে মাতা ও পত্নীর সম্মান ও মর্যাদা বেশ উচ্চ ছিল। সে যুগে অবরােধ বা পর্দাপ্রথা ছিল না। একজন স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম। তবে পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিধবা নারী জীবনের চরম অভিশাপ বলে বিবেচিত হতাে। মুছে যেত কপালের সিঁদুর এবং সেই সঙ্গে তার সমস্ত প্রসাধন ও অলঙ্কার। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাস বর্জন ও কৃছু সাধন করতে হতাে। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল। প্রাচীন বাংলায় ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনাে অধিকার ছিল না। তবে স্বামীর অবর্তমানে অপুত্রক বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারতাে। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। অপরদিকে, ব্রহ্মহত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদার গমন (পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক) ইত্যাদিকে মহাপাতকের কাজ বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

অনুশীলনমূলক প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি

প্রশ্ন : ১. প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বখ্যাত কোন কাপড় বাংলায় তৈরি হতাে?
ক. রেয়ন
খ. রেশমি
গ. মসলিন
ঘ, পশমি

২. প্রাচীন বাংলার অর্থনীতিকে কৃষিনির্ভর বলা হয়, কেননা এ সময়ে
i. বাংলার প্রধান ফসল ছিল ধান;
ii. ইক্ষু, তুলা ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল;
iii. প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট;

নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. ii ও iii
ঘ. i ও ii

উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও : কবিতা গ্রীষ্মের ছুটিতে মা-বাবার সাথে কুমিল্লার ময়নামতিতে শালবন বিহার পরিদর্শনে যায়। সেখানে গিয়ে লক্ষ করে যে, বিহারের মাঝখানে উঁচু ঢিবির উপর কেন্দ্রীয় মন্দির, চারপাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য অসংখ্য কক্ষ, দেয়ালে টেরাকাটা অঙ্কন। সবকিছু মিলিয়ে অপূর্ব প্রাচীন নিদর্শন।
৩. কবিতার দেখা প্রাচীন নিদর্শনের বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রাচীন বাংলার কোন নিদর্শনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়?
ক. ঢাকার আশরাফপুরের
খ. চট্টগ্রামের ঝেওয়ারির
গ. নওগাঁর পাহাড়পুরের
ঘ. বাঁকুড়ার বহুলাড়ার

৪. উক্ত প্রাচীন নিদর্শনে যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, তা হলাে –
i. বৌদ্ধদের নির্মিত।
ii. জ্ঞান সাধনার স্থান
iii. দেশে-বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

সৃজনশীল

প্রশ্ন : ১. টিনা তার বান্ধবীর বড় বােন নীলার বিয়েতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। নীলার পিতা গ্রামের সম্পদশালী ব্যবসায়ী। তিনি বিদেশে সুতিবস্ত্র, সিল্ক, ঔষধ, মিহি চাল রপ্তানি করেন। গ্রামে অনেক কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে। দরকারি অনেক জিনিস গ্রামেই তৈরি হয়। গ্রামের লােকেরা এখনও মাটির তৈরি কলস, হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহার করে। গ্রামে এখনও যথেষ্ট কৃষিজমি, চারণভূমি, হাট-বাজার, বন্দর যানবাহন চলাচলের পথ রয়েছে। এমন একটি গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে টিনা মুগ্ধ। বিয়ের দিন টিনা খুব সুন্দর করে সুতির শাড়ি, পায়ে আলতা, কপালে কুমকুম ও মাথায় ওড়না পরে সুন্দর করে চুলের খােপা বেঁধেছে। বিয়েবাড়িতে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, দধি ও ক্ষীর পরিবেশন করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে মসলাযুক্ত পান দেয়া হয়। বিয়ে ও খাবারের শেষে ছােট একটি গানের জলসার আয়ােজন ছিল।
ক. আর্যদের পূর্বে বাংলার ভাষার নাম কী?
খ. কীভাবে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে?
গ. উদ্দীপকে বর্ণিত খাদ্য ও পােশাক-পরিচ্ছদের সাথে বাংলার কোন আমলের মিল খুঁজে পাওয়া যায় । ব্যাখ্যা কর।
ঘ. নীলাদের গ্রামের আর্থিক কাঠামাে তৎকালীন বাংলার প্রতিচ্ছবি’– তুমি কি উক্তিটির সঙ্গে একমত?

যুক্তি দাও

২. সৌরভ ব্যানার্জী ও প্রদীপ বণিক দুই বন্ধু এবং একই শহরে বসবাস করে। সৌরভের বাবা কাপড়ের ব্যবসা করেন। তার দোকানে টাঙ্গাইলের তাঁত, রাজশাহীর সিল্ক ও জামদানি শাড়ি বিক্রি হয়। বর্তমানে তিনি সুতি কাপড় ও সিল্ক শাড়ি বিদেশে রপ্তানি করছেন। প্রদীপের বাবা চাল, চিনি, লবণ, মসলা ইত্যাদির ব্যবসা করেন। তিনি চিনি ও মসলা আমদানি করেন। একদিন প্রদীপ সৌরভদের বাড়িতে যায় এবং তার বােনকে দেখে নিজের বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রদীপরা সৌরভদের সমগােত্রীয় নয় বিধায় উক্ত প্রস্তাব বাতিল করে দেন সৌরভের মা-বাবা ।
ক. কখন থেকে বাংলায় মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়?
খ. প্রাচীন বাংলার মানুষের অবস্থা কেমন ছিল?
গ. সৌরভের বােনের বিয়ের ব্যাপারে তার মা-বাবার মনােভাবে তল্কালীন বাংলার কোন দিকটি ফুটে উঠেছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. তুমি কি মনে কর, প্রদীপের বড় ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে যে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, তা তৎকালীন বাংলার সমাজের অগ্রগতির অন্তরায়? যুক্তি দাও।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button