আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

লিঙ্কে ক্লিক করুন
সামাজিক বিজ্ঞান

নীল বিদ্রোহ সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো আপনার জানা প্রয়োজন

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের গণআন্দোলনের মধ্যে বাংলার নীল বিদ্রোহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিদ্রোহে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। নীল নামক একপ্রকার চারাগাছ থেকে রং সংগ্রহ করা হত। এ রং সুতিবস্ত্রে ব্যবহার করার জন্য অতি প্রাচীনকাল থেকে এদেশে নীলের চাষ হত।

মুসলমান আমলে কৃষকগণ ইচ্ছেমতাে নীলচাষ করত ও বিক্রয় করত। বাংলাদেশের ফরিদপুর, যশাের, ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় এবং ভারতের বারাসত, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি স্থানে নীলের চাষ হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ফলে বাংলা থেকে প্রচুর নীল ইউরােপের বাজারে রপ্তানি হয়। এ ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক ছিল।

প্রথম দিকে নীলচাষ ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাদের একচেটিয়া অধিকার লােপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছেমতাে নীলের চাষ শুরু করে। নীলকররা নীল-উৎপাদিত অঞ্চলসমূহে কুঠি স্থাপন করে। প্রত্যেক কুঠিতে কয়েদখানা ছিল। নীলকরদের নিজস্ব বেসামরিক বাহিনী ছিল। লাঠিয়াল, পাইক, পেয়াদা ও বরকন্দাজ নিয়ে গঠিত হত নীলকরদের বেসামরিক বাহিনী। নীলকররা কৃষকের উৎকৃষ্ট জমিতে দাগ দিয়ে নীলচাষে বাধ্য করত।

প্রথম দিকে নীলকরগণ বিনামূল্যে নীল চাষিদেরকে নীলের বীজ যােগান দিত। এ সময় তারা পারিশ্রমিকও পেত। পরে নীলকরগণ দাদন (অগ্রিম টাকা) দেওয়ার প্রথা প্রচলন করে। দাদন নেওয়ার সময় চুক্তিনামায় সই করতে হত। এতে উল্লেখ থাকত চাষি কী পরিমাণ জমিতে নীলচাষ করবে এবং কত দামে নীলগাছ নীলকরদের কাছে বিক্রি করবে। শর্ত অনুযায়ী দাদনের টাকা দিয়ে নীলচাষ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ চাষিকে বহন করতে হত। মাপজোকের বেলায় নীলকররা কারচুপির আশ্রয় নিত। দেড় বিঘা জমিকে তারা এক বিঘা হিসাব করত।

অনেক সময় নীলকরগণ জাল চুক্তিপত্র তৈরি করত। যেসব চাষি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করত এবং নীলচাষ করতে সম্মত হত না, তাদের ওপর চলত অমানুষিক অত্যাচার। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হত। তাদের স্ত্রী-কন্যাকে অপহরণ করা হত, তাদের গরু-বাছুর ধরে নিয়ে নীলকুঠিতে আটক করে রাখাহত। কোনাে কোনাে চাষিকে গুলি করে হত্যা করাহত। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হত।

নীলকরদের অত্যাচারে নীলকুঠি এলাকাস্থ প্রজাগণ গ্রাম ছেড়ে চলে যেত। এশলি ইডেন বলেছেন যে, খুন, দাঙ্গা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, অপহরণ প্রভৃতি এমন কোনাে অপরাধ নেই যা নীলকররা করত না। ১৮৫৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গােপাল লাল মিত্র বলেছেন যে, কৃষককে দাদনের টাকা হতে নীলকরের গােমস্তা, আমিন ও দাগিদারকে দিতে হত। এস্কনস নামে এক জজসাহেব মন্তব্য করেন যে, নীলকরের দালালদের অর্থলালসা মিটিয়ে কৃষকগণ দাদনের এক-তৃতীয়াংশ টাকাও বাঁচাতে পারত কিনা সন্দেহ।

নীল দর্পণ’ নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলকরদের এসব অত্যাচার, নিপীড়ন ও শােষণ সম্পর্কে নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন। ১৮৬০ সালে নীল দর্পণ’ প্রকাশের সাথে সাথে দেশে উত্তেজনা ও ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়। নীলকরদের অকথ্য অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষকেরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে লাগল। প্রথমে বিদ্রোহী নীল কৃষকেরা কর্তৃপক্ষের কাছে মানবিক দিক বিবেচনার জন্য আবেদন করে।

এ পর্যায়ে তারা শান্তিপূর্ণ মিছিল করে নিজেদের অভাব-অভিযােগ পেশ করে। তাদের আবেদন-নিবেদন নিষ্ফল হলে আন্দোলন এক ধাপ এগিয়ে যায়। এ পর্যায়ে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধভাবে নীলচাষ করতে অসম্মতি জানায়। এ আন্দোলন ছিল অহিংস ‘সত্যাগ্রহ। শান্ত ও নিরভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের ভিত্তিতে সংগ্রাম করাকে ‘সত্যাগ্রহ’ বলা হয়। নীলচাষ না করার জন্য চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার ইত্যাদি শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। ফরিদপুর, যশাের, পাবনা, রাজশাহী, মালদহ, নদীয়া, বারাসত প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ‘নীল কমিশন গঠন করেন। কমিশন সরেজমিনে নীলচাষিদের অভিযােগের সত্যতা পরীক্ষা করেন এবং অভিযােগ যথার্থ বলে অভিমত দেন। ফলে সরকার একটি আইন দ্বারা ঘােষণা করেন যে, নীলকররা বলপূর্বক চাষিকে নীলচাষে বাধ্য করতে পারবে না এবং তা করলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় হবে। এ আইন পাসের ফলে ১৮৬০ সালের নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

হিন্দু, মুসলিম, জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল নীলচাষির পারস্পরিক সহযােগিতা, শৃঙ্খলা এবং দৃঢ় সংকল্পের ফলে নীল বিদ্রোহ সাফল্যমণ্ডিত হয়। প্রথমদিকে এ আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ’। এ আন্দোলনে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে মহাত্মা গান্ধী বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ব্রিটিশ ভারতে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। নীল বিদ্রোহের শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, প্রয়ােজনে অশিক্ষিত, দুর্বল কৃষকেরাও সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায়, অত্যাচার ও শশাষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button