আমাদের সকল পোস্ট ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ফলো করুন :

Click Here
বাংলাদেশ বিষয়াবলী

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারবেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনগত কাঠামাে আদেশ বা এল.এফ. ও জারিকরণ সম্পর্কে বলতে পারবেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলাের বর্ণনা দিতে পারবেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনী ইস্যু ও ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আইনগত কাঠামাে আদেশ

১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপসহ আইনগত কাঠামাে আদেশ বা এল.এফ.ও (Legal Framework Order-LFO) জারি করেন। আইনগত কাঠামাে আদেশের বিধানগুলাে নিম্নরূপ:

এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন :

সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান :
  • সর্বজনীন ভােটাধিকার;
  • এক ব্যক্তি, এক ভােট’ নীতি;
  • প্রত্যেক প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রের জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা বন্টন।
জাতীয় পরিষদের গঠন সংক্রান্ত বিধান :
  • জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩ নির্ধারণ;
  • এলাকাভিত্তিক সাধারণ আসন সংখ্যা ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৩ নির্ধারণ;
  • জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রের আসন সংখ্যার বণ্টন নিম্নরূপ :
পূর্ব পাকিস্তান ১৬২+৭ =১৬৯
পাঞ্জাব ৮২+৩ = ৮৫
সিন্ধু ২৭+১ = ২৮
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ২৫+১ = ২৬
বেলুচিস্তান ৪+১ = ০৫
সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত বিধান :
  • পাকিস্তান হবে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র;
  • দেশে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে;
  • প্রত্যেক প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন, কেন্দ্রের হাতে প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডত্ব রক্ষা;
  • নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের নির্ধারিত সময়সীমা ১২০ দিন ধার্য। নির্ধারিত সময়সীমায় সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া এবং নতুন সাধারণ নির্বাচনের আয়ােজন;
  • জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমােদিত হওয়া আবশ্যকীয় হবে।

আইনগত কাঠামাে আদেশে কার্যত প্রেসিডেন্টের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জারিকৃত এই আদেশের তীব্র সমালােচনা করা হয়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি ও অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল :

১৯৭০ সালের নির্বাচনই স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদগুলাের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘােষণা করা হয়। কিন্তু উক্ত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় নি। পরে তা যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। ইতােমধ্যে ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে আকস্মিক এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে ঐ সব এলাকার নির্বাচন পিছিয়ে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১-এ নেওয়া হয় এবং যথারীতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বেশকিছু নির্দলীয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দু’ডজনের মতাে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক দলগুলাে হচ্ছে: আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পাটি (পিপিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াত-ই-ইসলামি, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, নিজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি (পি.ডি.পি.) ইত্যাদি।

এর মধ্যে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পাটি। তবে এ নির্বাচনের উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, কোন রাজনৈতিক দলই এলাকাভিত্তিক ৩০০টি আসনের সব কটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করেনি। উপরন্তু পূর্ব বাংলার এক সময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী) ‘ভােটে মুক্তি আসবে না’ শ্লোগান তুলে নির্বাচন বয়কট করে।

নির্বাচনী ইস্যু

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্যু ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬-দফা। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনের পূর্বে জাতির উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর রেডিও-টেলিভিশন ভাষণ এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযান কালে এ সাধারণ নির্বাচনকে ৬-দফা কর্মসূচির উপর ‘গণভােট’ বলে আখ্যায়িত করেন।

পূর্ব বাংলার উপর দুই দশকের অধিক সময়কালব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শােষণ-বঞ্চনা, আঞ্চলিক বৈষম্য, ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসিন্য ইত্যাদি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্ব সহকারে স্থান পায়।

আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে ৬দফা ও ১১-দফা গুরুত্ব সহকারে স্থান পায়। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনী শ্লোগান ছিল: ইসলাম আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি’।

পিপলস্ পার্টির প্রচারনার মূল বিষয়বস্তু ছিল শক্তিশালী কেন্দ্র ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং অব্যাহত ভারত বিরােধিতা। এ ছাড়া, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল বা গ্রুপ পাকিস্তান পিপলস পার্টির মত ইসলামি সংবিধান, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ভারত বিরােধিতার উপর তাদের নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্ব আরােপ করে।

নির্বাচনী ফলাফল

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ টি জাতীয় পরিষদের এলাকা ভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন এবং প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৭২.৫৭ ভাগ ভােট লাভ করে। বাকি ২টি আসনের মধ্যে একটিতে জয়লাভ করেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন এবং অপরটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়।

জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনের সব কয়টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সর্বমােট ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের মােট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে।

প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৮৯ ভাগ আওয়ামী লীগের অনুকূলে যায়। অন্যান্য ১২টি আসনের ৯টিতে জয়লাভ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি এবং একটিতে জামায়ত-ই-ইসলামি জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের সব কয়টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। অপরদিকে, জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলাকা ভিত্তিক আসনের মধ্যে ৮৩টি আসনে জয়লাভ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি বা পিপিপি। হিসেব অনুযায়ী প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৪২.২ ভাগ ভােট পিপিপি-র অনুকূলে পড়ে। বাকী ৫৫টি আসনের ৯টিতে মুসলীম লীগ (কাইউম খান), ৭টিতে মুসলীম লীগ (কাউন্সিল), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-ইসলাম, ৬টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়-ই-ইসলাম, ৪টিতে জামায়াত-ই-ইসলামি, ২টিতে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এবং ১৩টিতে নির্দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের ৫টিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং ১টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান) জয়লাভ করে। মহিলা আসনসহ পাকিস্তান পিপলস পার্টির মােট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে স্থান লাভ করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি।

সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে লক্ষণীয় বিষয় হলাে প্রধান এ দুটি রাজনৈতিক দলের কোনটিই দেশের উভয় অংশে আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়। মােদ্দাকথা আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি পূর্ব বাংলায় কোন আসনই জয়লাভ করতে পারে নি। নির্বাচনে জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে ৬-দফা ভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে এবং পশ্চিম পাকিস্তান শক্তিশালী কেন্দ্র, ইসলামি ব্যবস্থা প্রবর্তন ও ভারত বিরােধিতার পক্ষে নির্বাচনী রায় প্রদান করে।

সারকথা

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রধান দুটি দল ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি। ৬-দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি (৭টি মহিলা আসনসহ) আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব বাংলার জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২টি এলাকা ভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন লাভ করে।

পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও ৩১০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন পেয়ে এক বিপুল বিজয় অর্জন করে। অপরদিকে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৪৪ টি আসনের মধ্যে ৮৮টি (৫টি মহিলা আসনসহ) আসনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে দুটি দলের কোনটিই দেশের উভয় অংশে আসন লাভে সক্ষম হয় নি।

Md. Mahabub Alam

I am a committed educator, blogger and YouTuber and I am striving to achieve extraordinary success in my chosen field. After completing Masters in Anthropology from Jagannath University, I am working as Chief Accounts Officer in a national newspaper of the country. I really want your prayers and love.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button