বাংলা রচনা সম্ভার

আমার পড়া একটি বইয়ের গল্প

আমার পড়া একটি বইয়ের গল্প

আমি বই পড়তে খুবই ভালােবাসি। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আমি অনেক বই পড়ে থাকি। আমার আব্বা-আম্মা আমাকে প্রায়ই নতুন নতুন বই উপহার দেন। একদিন আব্বা আমার জন্য একটি বই নিয়ে আসেন। বইটির নাম দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। বইয়ের নাম ‘আম আঁটির ভেঁপু’।

গল্পের বইয়ের নাম এমন হতে পারে আমি কখনােই ভাবিনি। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা, আম আঁটির ভেঁপু কী? আব্বা বললেন, ‘আমের আঁটি থেকে একরকম বাঁশি বানানাে যায়, তাকে ভেঁপু বলে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আম আঁটির ভেঁপুর সঙ্গে গল্পটির সম্পর্ক কী? তিনি বললেন, ‘পড়ে দেখাে, বুঝতে পারবে।’

আমি বইটি হাতে নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে দেখতে লাগলাম। বইটির লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রচ্ছদে একটি মেয়ে একটি ছেলের হাত ধরে খােলা মাঠ ধরে দৌড়ে যাচ্ছে। বাতাসে মেয়েটির চুল উড়ছে। ছেলেটির হাতে একটি বাঁশি। আমি বইটি পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। সামনে গ্রীষ্মের ছুটি, ভাই পড়ালেখার তেমন চাপ ছিল না।

আমি বইটি নিয়ে পড়তে বসি। ‘আম আঁটির ভেঁপু এক কিশােরী ও তার ছােট ভাইয়ের গল্প। মেয়েটির নাম দুর্গা ও ছেলেটির নাম অপু। তারা নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের প্রান্তে ভাঙা বাড়িতে বাস করে। তাদের বাবা হরিহর মানুষের বাড়িতে পূজা করে যা আয় করে তা-ই দিয়ে সংসার চালায়। মা সর্বজয়া।

তাদের সাথে আরও থাকেন এক বৃদ্ধ পিসি। এই নিয়ে তাদের সংসার। বাবার আয়ে তাদের সংসার ভালােভাবে চলে না, অভাব অনটন লেগেই থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালােবাসার কোনাে কমতি নেই।

বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আম আঁটির ভেঁপু একটি দরিদ্র কিন্তু ভালােবাসাময় পরিবারের কাহিনি। দুর্গা খুবই খেতে ভালােবাসত। কিন্তু তার চাহিদামতাে খাবার দিতে পারত না তার মা-বাবা। তাই সে নানা জায়গা থেকে খাবার নিয়ে খেত।

খাবারের প্রতি আকর্ষণের জন্য দুর্গাকে প্রায়ই মায়ের হাতে উত্তম-মধ্যম খেতে হতাে। দুর্গা ছিল খুবই ডানপিটে মেয়ে, তাই মায়ের পিটুনি তার গায়েই লাগত না। সে টোটো করে বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু অপু ছিল লাজুক প্রকৃতির, দুর্গা ছাড়া তার আর কোনাে বন্ধু ছিল না। দুর্গা তাকে মারলেও সে দুর্গার পিছে পিছে ঘুরত। দুর্গা অপুকে নানা জায়গা থেকে ফলমূল এনে দিত। এতে অপু খুশি হতাে।

একদিন দুর্গাদের গরু হারিয়ে গেলে, অপু আর দুর্গা সেটা খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। গ্রাম ছেড়ে মাঠ পেরিয়ে তারা চলে যায় রেললাইনের উপরে। এ যেন একটা নতুন দেশ আবিষ্কার। তারা বিদ্যুতের থামে কান পেতে শব্দ শােনে। যখন দূর থেকে তারা ট্রেন আসতে দেখে, তখন দৌড়ে গিয়ে ট্রেনের পাশে দাঁড়ায়। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে ট্রেনের দিকে।

অপুদের এক প্রতিবেশী ধনী। তাদের বাড়ির এক মেয়ের বিয়েতে অপু ও দুর্গা যায় নিমন্ত্রণ খেতে। সেখানে একটি পুঁতির মালা হারিয়ে গেলে সবাই দুর্গাকে দোষারােপ করে এবং তাদের মেরে তাড়িয়ে দেয়। আমার মনে হলাে যেন তাদের সাথে আমিও ছিলাম। আমাকে যেন বিয়েবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল। এমন সময় মা আমাকে দেখে আদর করে জড়িয়ে ধরল। আমি খুবই লজ্জা পেলাম।

অপুর মধ্যে যেন আমি আমাকেই খুঁজে পাই। অপু লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় তার কোনাে বন্ধু নেই। সে একা একাই বাড়ির পাশের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। হাতে লাঠি নিয়ে যােদ্ধা সেজে সে গাছপালার সাথে যুদ্ধ করে। দুর্গা অপুকে মাকাল ফল এনে দিলে অপু যেন সাতরাজার ধন হাতে পায়। অপুর সঙ্গে আমিও বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। অপু তার বাবার সঙ্গে সন্ধ্যার সময় পড়তে বসে। এ সময় দূর থেকে ভেসে-আসা ট্রেনের শব্দে উদাস হয়ে যায় সে।

বইটি পড়তে পড়তে আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাই। অপুর বাবা নতুন কাজের সন্ধানে শহরে যায়। এমন সময়েই ঘটে সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। দুর্গা ও অপু একদিন বৃষ্টিতে ভেজে। তারপর দুর্গার জ্বর হয় এবং সেই জ্বরে দুর্গা মারা যায়। এতে অপু প্রচণ্ড আঘাত পায়। দুর্গা ছাড়া অপুর পৃথিবী একেবারে ফাঁকা।

অপুর বাবা ফিরে এসে ওদেরকে নিয়ে কাশী চলে যায়। একটু ভালােভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপুকে ছেড়ে যেতে হয় অতি চেনা, অতি আপন এই ভাঙা বাড়িটি। জিনিসপত্র গােছানাের সময় অপু একটি কৌটায় পুঁতির মালাটি খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে যে, দুর্গাই মালাটি চুরি করে এনে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল। অপু মালাটি ফেলে দেয়, যাতে কেউ এটা দেখতে না পায়। এভাবে অপু যেন দুর্গার দোষ পৃথিবীর কাছ থেকে আড়াল করে।

আমি আমার অল্প বয়সে অনেক বই পড়েছি। কিন্তু আম আঁটির ভেঁপু আমার হৃদয়কে যতখানি স্পর্শ করেছে, ততখানি অন্য কোনাে বই পারেনি। সারা জীবন এই বইটির কথা আমার মনে থাকবে। আমার প্রিয় বইগুলাের মধ্যে সবার উপরে থাকবে ‘আম আঁটির ভেঁপু’।

Bcs Preparation

BCS Preparation provides you with course materials and study guides for JSC, SSC, HSC, NTRCA, BCS, Primary Job, Bank and many other educational exams.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button